প্রকৃত সাংবাদিকদের মর্যাদা ম্লান করছে অপসাংবাদিকতা! প্রকাশিত: ৭:৩৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১০, ২০২৫ মো. মনির হোসেন: সাংবাদিকতা এক সময় ছিল সমাজ বদলের একটি মহৎ হাতিয়ার, কলম ছিল প্রতিবাদের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র, সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো মানেই ছিল সাংবাদিকতা- ভয়-ডরহীন, অনুসন্ধানী, দায়িত্বশীল, অথচ অপসাংবাদিকতার কারনে আজকের বাস্তবতা এতটাই ভিন্ন, যেন আমরা এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছি, কলমের কালি মুছে গিয়ে জায়গা করে নিয়েছে ইউটিউব সাংবাদিকতা, বর্তমানে ইউটিউব সাবস্ক্রাইবার, টিকটক ফলোয়ার আর লাইভ ভিডিওর নাটক করতে গিয়ে নানা রকম ভূল তথ্য দিয়ে কনটেন তৈরি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বির্ভান্তি সৃষ্টি করছে। এর ফলে প্রকৃত সাংবাদিকতা চলে যাচ্ছে আড়ালে আর অপ-সাংবাদিকতার নাটকের মঞ্চ সৃষ্টি হচ্ছে, প্রকৃত সাংবাদিকদের মর্যাদা ম্লান করছে অপসাংবাদিকতা। আজকাল সাংবাদিকতার চেহারা অনেকটা পলিথিনে মোড়ানো আমের শরবতের মতো- দেখতে চকচকে; কিন্তু গন্ধেই ধরা পড়ে আসল নকল। সাংবাদিকের সংজ্ঞা যেন কেউ আর বুঝতেই চায় না, যার হাতে ক্যামেরা, যার গলায় কার্ড- সে-ই সাংবাদিক! কেউ যদি বলে, ‘আমি মিডিয়া’- তাহলেই তার বিশেষাধিকার! পুলিশ থেমে যায়, ট্রাফিক স্যালুট দেয়, আর গ্রামের মানুষ তাকে ভক্তিভরে ‘স্যার ডাকে। আবার অনেক সময় দেখা যাচ্ছে অপসাংবাদিকতা যারা করছে তারাই আবার এর বিরুদ্ধে সভা সেমিনার করছে। আজকাল আবার এও দেখা যায় একজন মানুষ সকালে জুতা বিক্রি করে, বিকালে বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢুকে গলা ফাটিয়ে বলে ‘লাইভ চলছে! আর রাতে জেলা প্রতিনিধি নাম দিয়ে ফেসবুকে নিউজ শেয়ার করে, যিনি কাল পর্যন্ত অন্য পেশায় কাজ করতেন, আজ তার পকেটে ঝুলছে একটি রঙিন প্রেস কার্ড, কে বানাল? কীভাবে পেল? প্রশ্ন তোলার সাহস কই? সাংবাদিকতার নামে এই মঞ্চে আজ অনেকেই অভিনয় করছেন এমন এক চরিত্রে, যার পেছনে আছে চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিং, দলীয় প্রভাব, টেন্ডারবাজী, থানার দালালী ইত্যাদি ইত্যাদি। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, সারা দেশে যেদিকে তাকাই, সেদিকেই তথাকথিত ‘মিডিয়া অফিস’ চায়ের দোকান, বিউটি পার্লার, মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টারের পাশেই ঝোলানো ব্যানার- ‘অফিস অব দি ক্রাইম রিপোর্টার, জেলা প্রতিনিধি: জনাব নিজাম সাহেব! কে তাকে নিয়োগ দিল? সে কোন পত্রিকায় কাজ করে? সে পত্রিকা বের হয় কিনা, এগুলোর জবাব নেই, প্রয়োজনও নেই। দরকার শুধু কার্ড, ক্যামেরা আর গলা ফাটানো কিছু সংলাপ। বস্তুনিষ্ঠ, সৎ, নির্ভীক সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনে, একটি আদর্শ গণমাধ্যমের কোনো দল, গোষ্ঠী, সরকার, বিদেশি রাষ্ট্র বা কোনো এজেন্সির কাছে দায়বদ্ধতা থাকে না, দায়বদ্ধতা থাকে শুধু দেশের জনগণের কাছে, আমাদের মনে রাখতে হবে, গণমাধ্যমের পরাজয় মানে জনগণের পরাজয়, জনগণের পরাজয় মানে রাষ্ট্রের পরাজয়। দলবাজি, অপসাংবাদিকতা, হলুদ সাংবাদিকতা ও তথ্যসন্ত্রাস সাংবাদিকদের মর্যাদা ম্লান করে দিচ্ছে, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রশ্নে কোনো আপস করা চলে না, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে দখল করে নিয়েছে স্বার্থনির্ভর সাংবাদিকতা। বর্তমানে বাংলাদেশের গণমাধ্যম গুলি নানা সংকটে আবর্তিত, এই সংকট বেশী তৈরি করেছে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার। গণমাধ্যমকে সব সময় জনগণের পক্ষে থাকার কথা ছিল, কিন্তু জনগণের সঙ্গে গণমাধ্যমের একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে, আমরা দেখেছি সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গুম–খুনের কথা জিজ্ঞেস না করে তৈলমর্দন করতেন অনেক দালাল ও সিনিয়র সাংবাদিক, এবং সেটা প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা সভায় পরিণত হতো। এভাবে তাকে স্বৈরাচার থেকে মহাস্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট থেকে মহাফ্যাসিস্ট বানানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে দালাল ও সিনিয়র সাংবাদিকেরা, এ সত্য আমাদের স্বীকার করতেই হবে।’ তবে এই বাস্তবতায় প্রশ্ন একটাই, কে ফিরিয়ে আনবে সত্যিকারের সাংবাদিকতা? তথ্য মন্ত্রণালয়? প্রেস কাউন্সিল? নাকি সেই পাঠক, যিনি মুখে কিছু বলেন না, কিন্তু হৃদয়ে এখনো সত্য আর মর্যাদার জন্য অপেক্ষা করেন? সময় এসেছে সাংবাদিকতার সংজ্ঞা পুনর্গঠনের। সময় এসেছে বলার, সাংবাদিকতা কার্ডে নয়, চরিত্রে, মিডিয়া অফিসে নয়, মানুষের আস্থায়। আসুন, আমরা সেই সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াই, যারা আজও নীরবে সত্যের পক্ষে কলম চালান, যাদের হাতে আজও অন্ধকারে আলো জ্বালানোর সাহস আছে।না হলে খুব শিগগিরই হয়তো হেডলাইন হবে। লেখক পরিচিতিঃ সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার্স বাংলাদেশের আলো ও সভাপতি ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব। SHARES মন্তব্য প্রতিবেদন বিষয়: