প্রসংগ বেনজীরঃ কিচ্ছু হবে না! দেখবেন কিছুই হবে না!

প্রকাশিত: ১০:১৩ অপরাহ্ণ, জুন ১, ২০২৪

মো. মনির হোসেনঃ এক আড্ডায় বেনজীর প্রসংগে আলোচনার ফাকে একজন প্রশ্ন করেন আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় বেনজীর সাহেবকে বিচারের আওতায় নেওয়া হবে?” তাকে গ্রেফতার করা হবে? তাকে সরকার পালিয়ে যেতে সহায়তা করবেনা? সরাসরি এতগলো প্রশ্ন শুনে আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। কী জবাব দেব? জবাব দেওয়ার ঝামেলায় না গিয়ে বরং পাল্টা প্রশ্ন করলাম, “আপনার কী মনে হয়?”

তিনি যেন এই প্রসংগে কথা বলার সুযোগ পেয়ে কিছুটা খুশিই হলেন। কিছুমাত্র চিন্তা না করেই বললেন, শুনুন বেনজীর আহমেদ এক দিনে বেনজীর হননি, তাঁকে পুলিশের আইজি, র‌্যাবেবের ডিজি এ সরকারই বানিয়েছে, হঠাৎ তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বহির্বিশ্বে দেখানো হচ্ছে, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর। “কিচ্ছু হবে না, দেখবেন, কিছুই হবে না তার, পত্রিকায় এখন লেখালেখি হচ্ছে, কদিনের মধ্যে সব মিটমাট হয়ে যাবে। এরকম অনেক দেখেছি।” শেষ পর্যন্ত দেখবেন ফখরুদ্দিন আর মঈনুদ্দিনের মতো তিনি ও বিদেশেই থেকে যাবেন, দেশে আসার দরকার কি?

ভদ্রলোক একজন শিক্ষক, বেশ সেন্সিবল মানুষ। দেশ, জাতি সম্পর্কে খবরাখবর রাখেন। এরকম একজন মানুষ যখন অবলীলায় এমন মন্তব্য করেন, সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে তখন কিছুটা হতাশ হতেই হয়।

এদিকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবার জব্দের আগেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নিয়েছেন কি না তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। দুদকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ২৩ মে তাদের অ্যাকাউন্ট জব্দের আদেশ দেন আদালত। তবে এসব অ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ টাকা ছিল, তা জানা যায়নি। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরানোর মতো করে জমি, ফ্ল্যাট বা অন্য কোনো সম্পদ বিক্রি বা স্থানান্তর করেছেন কিনা, সে তথ্যও পাওয়া যায়নি, তিনি দেশে আছেন কিনা, তা নিয়েও ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, পরিবার নিয়ে বেনজীর দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। খবরটি কালের কন্ঠের অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ দেশে আছেন নাকি চলে গেছেন, সে ব্যাপারে জানেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেছেন, ‘আমি এখনো সঠিক জানি না, তিনি আছেন নাকি চলে গেছেন। আমাকে জেনে কথা বলতে হবে।’

গত শনিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

এদিকে বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পুরো বিষয়টি আরো পরিষ্কার করে বলেন, ডকুমেন্টের ভিত্তিতে কাজ করে ব্যাংক। ফলে সুনির্দিষ্ট আদেশের কপি ছাড়া মৌখিক কোনো তথ্য কিংবা গণমাধ্যমের খবরের ভিত্তিতে কারো অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে বা স্থানান্তর না করতে দেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা, আদালত কারো অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের আদেশ দিলে পরে স্থগিতাদেশ দিতে পারেন। এ রকম ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংক টাকা তুলতে না দিলে বিপদে পড়বে।

তিনি বলেন, সাধারণভাবে এ ধরনের ব্যক্তির বিভিন্ন পর্যায়ে নিজস্ব লোক থাকে। ফলে গোপনে জানিয়ে দেওয়া হতে পারে। আবার পত্রিকায় লেখালেখি এবং দুদকের কার্যক্রমের ফলে এমনিতেই তিনি টাকা সরিয়ে ফেলতে পারেন। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে নগদে তুলে বিশ্বস্ত কারো কাছে রাখা হয়। এখন দেখার বিষয় বেনজীর ও তাঁর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন প্রোফাইলের নিয়ম মেনে টাকা উত্তোলন হয়েছে কিনা। আবার টাকা উত্তোলন বা স্থানান্তরের পর ব্যাংকগুলো নিয়ম মেনে সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) এবং নগদ লেনদেন রিপোর্ট (সিটিআর) করেছে কিনা।

এদিকে, বেনজীর আহমেদের দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল সিটিজেন টিভির মালিকানার তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে এ টিভির অনুমোদনের সময় তারা দুইজনই ছিলেন শিক্ষার্থী।

দেশের সম্পদ অনুসন্ধান চলার মধ্যেই পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে বিদেশে থাকা সম্পদ অনুসন্ধানেও নেমেছে দুদক। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে তাঁদের কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, সেসবের খোঁজও নেওয়া হচ্ছে। দুদকের তিন সদস্যবিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটির প্রধান হাফিজুল ইসলামের সই করা চিঠি বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

বেনজীর সাহেব পুলিশের আইজিপি ছিলেন। পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পাওয়ার আগে ছিলেন র্যাবের ডিজি। তারও আগে ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুরো সময় ধরেই তিনি পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। টানা এতগুলো বছর দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে তার সুনাম ও দুর্নাম দুই-ই হয়েছে। তবে দুর্নামের পরিমাণ হয়তো কিছুটা বেশি ছিল। তবে বেনজীরের বেলায়ও সরকারের ভূমিকা কম প্রশ্নবিদ্ধ নয়। র্যাবের প্রধান হিসেবে তাঁর ভূমিকার জন্য দেশে–বিদেশে সমালোচিত হওয়া সত্ত্বেও সরকার রাজনৈতিক কারণেই তাঁকে পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে পদোন্নতি দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ম্যাগনেটস্কি অ্যাক্টে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর দলীয় সমর্থকদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ‘গুরুত্বহীন’ প্রমাণের উদ্দেশ্যে তাঁকে জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে পাঠানো হয়, যে সম্মেলনে পুলিশপ্রধানের উপস্থিতি আবশ্যক ছিল না। তখন বেনজীর যুক্তরাষ্ট্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের আয়োজিত এক নাগরিক সমাবেশে সরকারবিরোধীদের কড়া সমালোচনা করে রাজনৈতিক বক্তৃতা দেন।

মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার, র্যাবের ডিজি, পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল—গুরুত্বপূর্ণ এই পদগুলোতে ধারাবাহিকভাবে থাকাকালীন তার ক্ষমতার দাপট, নীতি-নৈতিকতা নিয়ে চটকদার কথাবার্তা, আর সেই সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে উচ্চারিত হওয়া নানাবিধ স্ক্যান্ডালের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত ছিলেন। অনেকেই অনেক কিছু জানতেন, কিন্তু প্রকাশ্যে উচ্চারণের হয়তো সাহস পেতেন না। তার অবসরগ্রহণের দুই বছর পর সেই প্রকাশ্য উচ্চারণটাই এখন হচ্ছে।

এখন কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা এক জীবনে কিভাবে হাজার কোটি টাকা অর্জন করতে পারে? টাকাগুলো যে বৈধ নয়, সেটা উপলব্ধির জন্য রকেট সায়েন্স অধ্যায়নের দরকার পড়ে না। বৈধ হলে সেগুলো তিনি তার স্ত্রী আর কন্যাদের নামে করতেন না। নিজে বাঁচার জন্য বলতে গেলে তিনি তার স্ত্রী-কন্যাদের ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টার যদি কখনো সুবিচার হয়, যদি অপরাধ প্রমাণ হয়, ওনার পাশাপাশি এই তিন নারীর নামের সঙ্গেও কিন্তু দুর্নীতির কলঙ্কটি লেগে যাবে। লোভ দ্বারা মানুষ কতটা পরিচালিত হলে অতি প্রিয় স্ত্রী-কন্যাদের মান-সম্মান নিয়ে জুয়া খেলতে পারে!

যে কথাটা বলছিলাম, কিভাবে সম্ভব এক জীবনে এত বিপুল দুর্নীতি করা? আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা কি সরকারি কর্মকর্তাদের এত বড় বড় দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেয়? নাকি, কর্মকর্তারাই বেপরোয়া আচরণের মাধ্যমে এসব করে থাকে? সম্ভবত এক্ষেত্রে পরের অপশনটাই কাজ করেছে। আইজিপি তো বেনজীর আহমেদই প্রথম বা একমাত্র ছিলেন না। আরও অনেকেই ছিলেন। এই মাপের দুর্নীতির কথা আগে কখনো শোনা যায়নি। হয়তো অনেকে করেছেন, কিন্তু এভাবে প্রকাশিত হয়নি। হয়তো এখনো অনেকে করছেন। কে জানে তারা যখন অবসরে যাবেন তাদের গুলোও প্রকাশিত হবে, অথবা হবে না।

লেখাটা শেষ করি বরং শুরুর প্রসঙ্গটা দিয়ে। আমার পরিচিত সেই শিক্ষক সাহেব বলেছিলেন, ‘‘কিছুই হবে না।” এত দৃঢ়ভাবে তার অমন উচ্চারণ কি একেবারে অমূলক? তা নয় বোধকরি। এদেশে আসলে সরকার সংশ্লিষ্টদের কিছু হয় না। সরকার তো আসলে ভিন্ন কিছু নয়, এদের নিয়েই সরকার। সরকার নানা অগণতান্ত্রিক কাজ করে, এরা তাদের পুরো প্রতিষ্ঠান দিয়ে সেই অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ডকে সহযোগিতা করে। আর বিনিময়ে সরকার তাদেরকে সুযোগ দেয় দুর্নীতি করার। এভাবেই তো চলছে দেশ। বেআইনীভাবে এক বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচারের খবর আমরা পড়েছি। জেনেছি মন্ত্রীর বিদেশে থাকা হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির কথা গোপন করার কথা। একাধিক এমপির বিদেশে বাড়ি-সম্পদ আছে—তার তথ্য প্রমাণ প্রকাশিত হয়েছে, কোনো জবাবদিহিতা দেখিনি। গোয়েন্দা সংস্থা, দুদক, সরকার, বিচার বিভাগ—কেউ কিছু বলেনি। এসব দেখে দেখে আমাদের চোখ সয়ে গেছে। এসব হতে দেওয়া বা মেনে নেওয়া যে সরকারের জন্য বিব্রতকর বা লজ্জার—সেটা বোধকরি সরকার নিজেও মনে করে না।

কে যেন একজন বলেছিল, ‘আপনি যদি সিদ্ধান্ত নেন যে—আপনি লজ্জা পাবেন না, তাহলে কেউই আপনাকে লজ্জা দিতে পারবে না।’ আমাদের কর্তাব্যক্তিরা বোধকরি সেরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন।

দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সমসাময়িক দুই প্রধানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এখন আলোচিত হচ্ছে, তাঁরা দায়িত্বে থাকাকালে সম্ভব ছিল না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অন্তত সংসদে জবাবদিহির প্রশ্ন থাকে। শুধু ‘হ্যাঁ’ বলায় অভ্যস্ত একদলীয় সংসদে সেই অবকাশও নেই। সুতরাং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি কোনোভাবেই নাকচ করা যায় না। এ ধরনের সুবিধা দেওয়ার প্রবণতা যে ক্ষমতার স্থায়িত্ব বাড়ানোয় সুবিধাভোগীর কাছ থেকে প্রতিদানের আশায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষয়সাধনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে, তা নিয়ে প্রচুর গবেষণাও রয়েছে। আর দুদকের তদন্ত ও বিচারের ওপর আস্থা রাখার অবকাশই–বা কই? যুবলীগ নেতা সম্রাটের গ্রেপ্তারের পরও বলা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ যে কাউকে ছাড় দেয় না, এটি তার প্রমাণ। কিন্তু সেই সম্রাটের বিচার আর এগোয়নি এবং তিনি মুক্ত জীবন যাপন করছেন। এ রকম নজিরের তালিকা অনেক দীর্ঘ।

লেখকঃ সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার্স, দৈনিক বাংলাদেশের আলো ও সাধারণ সম্পাদক, ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব।