সংস্কার, নির্বাচন ও জুলাই সনদ !!

প্রকাশিত: ৯:৪৫ অপরাহ্ণ, জুন ১৮, ২০২৫

মো. মনির হোসেনঃ লন্ডনে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক শেষে দেয়া যৌথ বিৃবতিতে যে বিষয়ে জানানো হয়েছে, তাহলো রমজানের আগেই বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, এক্ষেত্রে অবশ্য ওই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল নয়টা ১০ মিনিটে বৈঠকটি শুরু হয়। শুরুতে পরিচিতি পর্বে অংশ নেন দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা, পরে রূদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, অন্য প্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন না।

তবে এখনও পরিষ্কার নয় ফেব্রুয়ারির মধ্যে সরকার আসলে কোথায় কতটুকু সংস্কার করতে চায়, গত ১০ মাসে কী কী সংস্কার হলো—তা নিয়েও বিতর্ক আছে। ১১টি সংস্কার কমিশন যে কয়েকশ সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক দফা আলোচনা হয়েছে এবং দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা চলছে। যেসব কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হয়নি, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী? সরকার কি আলোচনা বা ঐকমত্য ছাড়াই সেগুলোর বাস্তবায়ন করতে চায় নাকি বাস্তবায়নের জন্য পরবর্তী সরকারের ওপর ছেড়ে দেবে?

এদিকে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনার পরে কোন কোন বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হলো আর কোন বিষয়গুলোয় এখনও ঐকমত্য হয়নি, আনুষ্ঠানিকভাবে তার কোনো তালিকা সরকার এখনও দেয়নি। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, সেগুলোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী হবে? ফেব্রুয়ারির মধ্যে যদি সরকার প্রধানের ভাষায় ‘সংস্কারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন’ করা না যায়, তাহলে এর দায় কি বিএনপিকে বহন করতে হবে এবং এই কারণে নির্বাচন পিছিয়ে যাবে?

যেহেতু বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপিই দ্রুত তথা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছিল, ফলে এখন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকার কি তাহলে কিছু শর্ত দিয়ে বিচার ও সংস্কারের প্রক্রিয়ায় বিএনপিকে অধিকতর দায়িত্বশীল করে দিলো? অর্থাৎ দ্রুত নির্বাচন চাইলে দ্রুত বিচার ও সংস্কার শেষ করো—এরকম একটি বাধ্যবাধকতা তৈরি করে দেওয়া হলো কি না এবং সেটি বিএনপির জন্য একটি বড় চাপ তৈরি করবে কি না?

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে লন্ডনে তারেক রহমানের বৈঠকের পর আপাতদৃষ্টিতে ‘নির্বাচন কেন্দ্রিক সংকট উত্তরণ’ করা গেছে মনে হলেও সত্যিকার অর্থেই সে সংকট কতটা দূর হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে।

রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকদের কারও কারও ধারণা, প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক জটিলতা এখনো কাটেনি, বরং সামনের সময়টায় ‘রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও জটিল’ হয়ে উঠতে পারে বলেও বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন।

বৈঠকের পর কেবলমাত্র নির্বাচন কেন্দ্রিক সময়সীমার বিষয়ে আলােকপাত করেছে সরকার এবং বিএনপি।

তবে, বৈঠকের সম্ভাব্য ফলাফল, রাজনীতিতে এর তাৎপর্য এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলাের প্রতিক্রিয়া – এমন নানা বিষয় নিয়ে এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে আলােচনা চলছে।

তবে এটা ঠিক যে, নির্বাচন যখনই হোক, সেটি যদি শুধুমাত্র একটি ক্ষমতার পালাবদল হয়ে যায়; যদি অতীতের সরকারগুলোর মতো দেশে একদলীয় এবং পরিবারকেন্দ্রীক রাজনীতি ঘুরপাক খেতে থাকে; যদি উন্নয়নের নামে লুটপাটের মহোৎসব চলতে থাকে; যদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মতোই দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে; রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো যদি আগের মতোই বিরোধী মত দমনের হাতিয়ার হিসেবেই কাজ করতে থাকে—তাহলে প্রমাণ হবে যে, ওই নির্বাচন গণতান্ত্রিক উত্তরণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।

এমতাবস্থায়, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে জুলাই সনদ তৈরি হওয়ার কথা, সেখানে নির্বাচনের পরে গঠিত সরকার কীভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, তার সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি ও কর্মসূচি লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। সেখানে এমন একটি আইনি বাধ্যবাধকতা ও কমিটমেন্ট থাকতে হবে, যাতে বিজয়ী দল সরকার গঠন করেই ওই সনদ ছুঁড়ে ফেলতে না পারে।

সুতারাং, বিচার ও সংস্কারের দোহাই দিয়ে নির্বাচন যেমন দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখার সুযোগ নেই, তেমনি শুধুমাত্র একটি দলের পরে আরেকটি দলকে ক্ষমতায় এনে পুরোনো পদ্ধতির চক্রে দেশকে ঠেলে দেওয়াটাও কোনো কাজের কথা নয়। বরং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে যৌক্তিক সময়ে মধ্যে নির্বাচন হতে হবে এটা যেমন ঠিক, তেমনি আগামী নির্বাচনের পরে যে সরকার গঠিত হবে, তাদেরকে পুরোনো ধ্যান-ধারণার বাইরে গিয়ে নতুন রাষ্ট্রচিন্তা ও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে পূর্বশর্ত সুশাসন—সেটি নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। জুলাই সনদে তার অঙ্গীকার ও বাস্তবায়নের কর্মপদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।

লেখকঃ সিনিয়র স্টাফ স্টাফ রিপোর্টার দৈনিক বাংলাদেশের আলো ও সভাপতি, ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব।