মে দিবস আসে মে দিবস যায়, শ্রমিকদের ভাগ্য কি বদলায়?

প্রকাশিত: ১০:৪৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৩০, ২০২৪

মো. মনির হোসেনঃ পয়লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। দিনটিকে আমরা মে দিবস বলেও জানি। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রম অধিকার আদায়ের এ দিনটি বছরের পর বছর ধরে বিশ্বব্যাপী যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। শ্রমিকদের সম্মানে মে দিবস বা পয়লা মে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালন করে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ। কিন্তু যাঁদের নিয়ে এই দিবস, তাঁরা এ সম্পর্কে কতটা অবগত? অনেক শ্রমিক জানেনই না এর ইতিহাস। তবে মে দিবস আসে মে দিবস যায়, শ্রমিকদের ভাগ্য কি বদলায়?

১৮৮৬ সালের এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওইদিন তাদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনকে তখন থেকেই সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে।

মহান মে দিবস, দিনপঞ্জিকার নিছক একটি দিন নয়। বিশ্বের শ্রমজীবী মেহনতি জনণের ঐক্য, সংহতি, সংগ্রাম ও বিজয়ের মধ্যে দিয়ে রচিত হয় ইতিহাসের এই দিনটি। মুনাফালোভী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অমানবিক নিপীড়নের শিকার শ্রমজীবী মানুষের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে অব্যাহত সংগ্রামের স্মারক মহান মে দিবস। শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকের ঐতিহাসিক বিজয়ের এই দৃষ্টান্ত যুগের পর যুগ সারা বিশ্বের শ্রমজীবী জনগণকে আন্দোলন-সংগ্রামে প্রেরণা যুগিয়ে চলেছে। আর তাই শ্রমিকদের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ‘মে দিবস’ লাভ করেছে বিশ্বব্যাপী সার্বজনীনতা।

ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশ

আমেরিকার শিকাগো শহরের শহীদ শ্রমিকদের অনুপ্রেরনায় ভারতবর্ষেও দাবি আদায়ে ধর্মঘট আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। রেল, চা বাগান ও স্টিমার শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও সংহতি ব্রিটিশদের কাঁপিয়ে তোলে ১৯২০ সালের দিকে। পরবর্তীকালে সুতাকলসহ বিভিন্ন কলকারখানায় শ্রমিকদের দাবী আদায়ের জন্য সংগঠিত হতে থাকে। ঐ সময় গড়ে ওঠা ট্রেড ইউনিয়নসমূহ পালনের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ওই সময় অধিকাংশস্থানে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় গোপনে গোপনে মে দিবস পালিত হয়।

এই উপমহাদেশে প্রথম মে দিবসের অনুষ্ঠান পালন করা হয় মাদ্রাজে ১৯২৩ সালে। তৎকালীন বাংলার শিল্পকেন্দ্র কলকাতায় সর্বপ্রথম মহান মে দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয় ১৯২৭ সালে। একই সময় তৎকালীন পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশে মে দিবস পালিত হয়।

১৯৩৮ সালে নারায়ণগঞ্জে মে দিবস পালনের খবর পাওয়া যায়। দাবী আদায়ের জন্য পরবর্তী কোন কোন বছর মে দিবসে ধর্মঘট পালিত হয়। মে দিবসে ছুটি দেওয়ার দাবী উত্থাপিত হয় সর্বত্র। পুরো পাকিস্তান আমল ঐক্যবদ্ধ ও পৃথক পৃথকভাবে প্রতিবছর উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে মে দিবস পালিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামসহ অন্যান্য আন্দোলনে অংশগ্রহনের মাধ্যমে আমাদের দেশের শ্রমিকরা প্রমান করেছেন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন থেকে বিছিন্ন থাকতে পারে না। আইন করে বা নানা কূটকৌশলের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন তার নিজস্ব গতিতে চলে।

মে দিবস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

মহান মে দিবসের আন্দোলনের একশ আটত্রিশ বছর পূর্তি হল। এ সময়ে পৃথিবীতে অনেক বড় বড় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মানষের সামাজিক অগ্রযাত্রায় অনেক অর্জন ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আজ স্বীকৃত মানবাধিকার। মে দিবসের প্রধান দাবী আট ঘন্টা কাজ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আইন করে বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং শ্রমিকের মৌলিক অধিকার, যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কাজের নিশ্চয়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। শ্রম আইনে শ্রমিকের আট ঘন্টা কাজ, বিশ্রাম, ছুটিসহ অন্যান্য অধিকারকে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের আলোকে নিশ্চিত করা হয়েছে, যা ছিল মে দিবসের আন্দোলনকারী শ্রমিকগণের প্রধান দাবী। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে, এত সব অর্জনের পরেও সামগ্রিক লক্ষ্য অর্জনে এখনও অনেক পথ বাকি আছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে এমন অনেক পেশা রয়েছে যেখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ এখনও মে দিবসের পূর্বের জমানায় রয়ে গেছে।

বেসরকারী হাসপাতাল/ক্লিনিক/ ডায়াগনিস্টিক সেন্টার/প্যাথলজি ল্যাব

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে আনুমানিক সাড়ে সাত হাজার বেসরকারী হাসপাতাল/ক্লিনিক/ডায়াগনস্টিক সেন্টার/প্যাথলজি ল্যাব রয়েছে। এদের মধ্যে ২,৭১৮ টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং ৪,৫৯৮ টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাব। মোট কর্মরত শ্রমিকের কোন নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। জরীপের ফলাফলে দেখা যায়, এ খাতে কর্মরত শ্রমিকের দুই-তৃতীয়াংশের বেশী (৬৮%) নারী। এক-তৃতীয়াংশের বেশী (৩৪%) এইচ, এস, সি বা তদুর্দ্ধ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

এ খাতে কর্মরত প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩২%) শ্রমিকের কোন নিয়োগপত্র নেই। এক-তীয়াংশের (৪২%) বেশী শ্রমিক দৈনিক আট ঘন্টার বেশী কাজ করেন। যারা আট ঘন্টার বেশী কাজ করে তাদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশের বেশী (২৮%) দৈনিক এগার থেকে বার (১১-১২) ঘন্টা কাজ করেন। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ (৭২%) শ্রমিকের মে দিবসে কোন ছুটি নেই। পঞ্চাশ শতাংশ (৫০%) শ্রমিককে সরকারী ছুটির দিনে কাজ করতে হয়। প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২২%) শ্রমিকের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। ছুটির দিনে তারা পরিবারের সাথে বাসায় সময় কাটান (৬৪%), পরিবারকে সাথে নিয়ে ঘুরতে বের হন (২২%), সন্তানের সাথে সময় কাটান (৮%), সিনেমা দেখেন (৪%), এবং প্রয়োজনীয় অন্যন্য কাজ সারেন (৪%)।

এ খাতে কর্মরত শ্রমিকরা মাসিক ভাবে মজুরী পান। মাসিক মজুরী গড়ে সাত হাজার পাঁচশত টাকা থেকে পনের হাজার টাকার মধ্যে (৮০%)। এক-তৃতীয়াংশের বেশী শ্রমিক (৩৮%) মাসিক দশ থেকে বার হাজার পাঁচশত টাকা মজুরী পান এবং প্রায় এক-তীয়াংশের (৩২%) মাসিক মজুরী বার হাজার পাঁচশত টাকা থেকে পনের হাজার টাকার মধ্যে। এ খাতে কর্মরত শ্রমিকদের সংগঠন বা ইউনিয়ন সংশিষ্টতার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।

মহান মে দিবস ও শ্রমিকদের আইনগত সুরক্ষা

১৮৮৬ সাল থেকে আট ঘন্টা শ্রমিকদের ‘কর্মঘন্টা’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করে যা বর্তমানে শ্রমিকদের আইনগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ১০০ ধারায় আট ঘন্টা কাজের বাধ্যবাধকতা বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। অথচ প্রতিনিয়ত আমাদের শ্রমিকদের কাজ করতে হয় তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি সময়। দু:খজনক হলেও সত্য, দেশের সকল শ্রমিক শ্রম আইনের আওতাভুক্ত নয়। তাই শ্রমিকদের অধিকার যা শ্রম আইন দ্বারা

সুরক্ষিত তার সুবিধা দেশের সিংহভাগ শ্রমিক ভোগ করতে পারছে না। দেশের শ্রম আদালত শ্রম আইন দ্বারা গঠিত বলে এর এখতিয়ার কেবল শ্রম আইনের আওতাভুক্তদের জন্য প্রযোজ্য। অন্যান্য শ্রমিকের এই আদালত থেকে সুরক্ষা পাওয়ার কোন সুযোগ নেই।

আবার, শ্রম আইনের ৫ ধারায় শ্রমিক নিয়োগের সময় নিয়োগ পত্র এবং নিয়োগকৃত শ্রমিকদের ছবিসহ পরিচয় পত্র প্রদানের বিষয়ে নিয়োগকারীদের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হলেও শ্রম আইনভুক্ত অল্প সংখ্যক শ্রমিকই নিয়োগ পত্র ও পরিচয় পত্র পেয়ে থাকে। এদিকে, নিয়োগ পত্র ও পরিচয় পত্র না থাকলে শ্রম আদালতে মামলাও দায়ের করা যায় না। ফলে প্রতিনিয়ত বঞ্চনার সম্মুখীন হচ্ছে শ্রমিকগণ। আবার, শ্রম আদালতের সংখ্যা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শ্রমিক সংখ্যা উলেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেলেও শ্রম আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি। ফলে শ্রম আদালতসমূহের উপর চাপ পড়ছে। শ্রম আদালতে ৬০ দিনে একটি মামলার কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মামলা অনিষ্পত্তিকৃত অবস্থায় পড়ে থাকছে বছরের পর বছর। আর, শ্রমিকের কর্মস্থল থেকে শ্রম আদালতের দুরত্ব বেশি থাকায় প্রতিকার চাইতে শ্রমিক শ্রম আদালতে আসতেই পারেনা।

তবে রানা প্লাজা, তাজরীন গার্মেন্টস, রূপগঞ্জসহ অনেক দুর্ঘটনায় অসংখ্য শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন, জীবন্ত পুড়ে কয়লা হয়েছেন। সেই সঙ্গে হারিয়েছেন বহু আশা ও স্বপ্ন। অনেক পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সামান্য ক্ষতিপূরণে তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। অনেক সময় সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলেও মালিক-শ্রমিক সমন্বয়হীনতায় বৃথা যায় সব।

এতেই বোঝা যাচ্ছে, আমাদের শ্রমিকদের অবস্থা কতটা শোচনীয়। কিন্তু মে দিবস যায়, মে দিবস আসে। তাঁদের ভাগ্য দ্রুত আর পরিবর্তন হয় না। ফলে পালনের জন্য মে দিবস পালন না হোক। এর মুখ্য উদ্দেশ্যই হোক শ্রমিকের অধিকার আদায় ও শ্রমিকের নিরাপত্তা। আট ঘণ্টার অধিক কাজ নয়। এর বেশি কাজ করলে ন্যায্য মজুরি দিতে হবে, সেটি সময়মতোই। বাংলাদেশে অসংখ্য শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। শ্রমিকদের স্বার্থে তাদের আরও বেশি অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। শ্রমিকদের সব দাবি মালিকপক্ষ বা সরকারের কাছে তারা তুলে ধরতে পারে। তাতে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের দূরত্ব অনেকখানি লাঘব হবে। শ্রম আইনগুলো কঠোরতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে তৈরি করতে হবে শ্রমিকবান্ধব আইন, যা শ্রমিকদের স্বার্থে কথা বলবে। এর মাধ্যমে গড়ে উঠবে একটি বৈষম্যহীন শ্রমিক সংঘ এবং এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের অর্থনীতি।