আমাদের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও সামাজিক অবক্ষয়

প্রকাশিত: ৯:০৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৩

মো. মনির হোসেনঃ উপমহাদেশের বৃহত্তম দেশ ভারতে সরকার রেখেই নির্বাচন হয়। তবে ভারত ফেডারেল রাষ্ট্র, বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন দলের সরকার থাকে, তা ছাড়া ভারতের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ শক্তিশালী এবং আমলাতন্ত্র দক্ষ ও নিরপেক্ষ। রাজনৈতিক সংস্কৃতিও বেশ উন্নত। ভারতে নির্বাচনকালে সরকারের প্রভাব ও ক্ষমতা সংকুচিত থাকে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন ‘সুপার’ সরকার হয়ে ওঠে। এর ওপর রয়েছে বিচার বিভাগ। শুধু ভারত নয়, মাত্র দেড় দশকের গণতান্ত্রিক দেশ নেপালে সরকারের তত্ত্বাবধানেই নির্বাচন হয়েছে। অথচ ছোট সরকার পরবর্তী সরকারই গঠন করতে পারেনি, কারণ, নেপালের সংবিধান ও আইনে নির্বাচনকালে সরকারব্যবস্থার ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া লিপিবদ্ধ রয়েছে।

সে তুলনায় আমরা এখনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে রয়েছি। অতীতে যে সুযোগ ছিল, তা-ও হাতছাড়া হয়েছে। ২০১৪-১৮ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়নি যে দলীয় সরকারের অধীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের হারই কি নির্বাচনের মাপকাঠি, এমন প্রশ্ন অনেকেই করেন।

২০২২ সালে বর্তমান কমিশনের ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন ভালো হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে ওগুলোই মাপকাঠি নয়। অতীতের বহুল আলোচিত দুই কমিশনের অধীন অনেক স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষা কেমন হয়েছিল, সে বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কাজেই কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন ভালো হয়েছে বলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো জটিল নির্বাচনও কি ভালো হবে? আশাবাদ থাকতে পারে, এমন আগাম কথা বলা কঠিন।

একটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় তখনই, যখন প্রত্যেক ভোটার তাঁর ভোটটি পছন্দনীয় প্রার্থীকে অথবা প্রতীকে নির্বিঘ্নে দিতে পারেন এবং ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি, গাফিলতি অথবা অদক্ষতাজনিত ত্রুটি না থাকে। একটি নির্বাচন সার্বিকভাবে সর্বজনীন হতে হবে। এমন ব্যবস্থা করার দায়িত্ব শুধু কমিশনেরই নয়, মুখ্য ভূমিকা সরকার ও অংশীদারকে নিতে হয়। তবে নির্বাচন কমিশনের গুরুদায়িত্ব সে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

তবে নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, প্রশ্নবিদ্ধ না হয় তাহলে তাতেই আমাদের স্বস্তি ও সন্তুষ্টি। সেই সুষ্ঠু নির্বাচনে যে পদে যে দলের প্রার্থীই বিজয়ী হোন আমাদের বলার কিছু নেই। কিন্তু এখন আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা যেখানে গেছে সেটি বলতে গেলে একটি দুঃস্বপ্নের মতো।

প্রথমত আলোচনা করা যাক একজন ইউ, পি সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা নিয়ে, ধরুন সে নির্বাচিত হতে গিয়ে প্রায় দশ লক্ষ টাকা নির্বাচনে ব্যয় করেছেন, যদি ও নির্বচন কমিশন কর্তৃক তার একটি নির্বাচনী ব্যয় (লোক দেখানো)বেধে দেওয়া হয়েছে, আর সে টাকাতে তো সে নির্বাচন করলে নির্বাচিত হতে পারবে না, কারন তার প্রতিদন্ধী প্রার্থী তার চেয়ে ও বেশী ব্যয় করার জন্য প্রস্তুত।

এখন প্রশ্ন হলো এ ব্যয় সে কিভাবে করবে? ধরা যাক সে নির্বাচন অফিস থেকে ফরম কেনা, সাথে বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে শো ডাউন করা, পোস্টার ফেস্টুন, লিফলেট বিতরন করা, কর্মীদের জন্য ক্যাম্প তৈরী করা, নিজের এলাকাতে একাধিক প্রার্থী থাকলে তাকে অর্থের বিনিময় ম্যানেজ করা, প্রতিদিন ছোট আকারে মিছিল করা, আবার প্রতিদন্ধী প্রার্থীর চেয়ে বেশী জনবল নিয়ে মিছিল করা, প্রতিদিন কমপক্ষে ত্রিশ জন কর্মী বাহিনী অর্থের বিনিময়ে তাদের দ্বারা নির্বাচন পরিচালনা করা, সর্বশেষ উপদেস্টাদের পরামর্শে কিছু এলাকা থেকে কিছু ভোট কেনা, পোলিং এজেন্ট নিয়োগ ইত্যাদি ব্যয় আবার আমাদের সমাজে কিছু লোক আছে(শিক্ষিত অশিক্ষিত) প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য তৈরি হয়েই থাকেন।

এখন প্রশ্ন হলো তিনি যে প্রায় দশ লক্ষ টাকা ব্যয় করলেন সেটা হয়তো তার পকেটের অথবা জমি বিক্রি করে যেখান থেকেই হোক সে নির্বাচিত হওয়ার জন্য এ ব্যয় করেছেন। এখন নির্বাচিত হয়ে এ ব্যয় করা টাকা সুদে আসলে উঠানোই তার প্রধান লক্ষ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এখন ধরা যাক একজন ইউপি সদস্যের আয়ের পথ কি হতে পারে, যেমন ট্রেড লাইসেন্স করে দেওয়া, নিজ এলাকাতে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ পাওয়া এবং জনগনের থেকে আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ কমপ্লিট করা, জমির ব্যবসা করা ইত্যাদি। উদাহরন হিসেবে একজন ইউপি সদস্যের নির্বাচনী ব্যবস্থা তুলে ধরা হলো। তবে যতো যোগ্যতা সম্পন্ন লোকই হোক সে কি এই ব্যয় ছাড়া নির্বাচিত হতে পারবেন? যোগ্যতার ভিত্তিতে আমরা কি ভোট দেই?

আমার জানামতে, দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে ও দেখছি নির্বাচনে টাকার খেলা বিশেষ করে সাংবাদিক, আইনজীবিদের মতো ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে টাকার বিনিময়ে অযোগ্য লোকদের ভোট প্রদান করা হয়।

তবে যাঁরা ১৯৫৪ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত জাতীয় পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের স্মৃতিচারণা করতে পারেন, তাঁরা বলবেন, নির্বাচনী ব্যয়ের সহজ সীমারেখা টানা যেত তখন। খরচের ক্ষেত্রগুলো কী ছিল? বাঁশের বেড়া দিয়ে নির্বাচনী প্রচারকেন্দ্র বানানো। এখানে বিড়ি, চা আর টোস্ট বিস্কুটের ব্যবস্থা রাখা। ব্যানার-ফেস্টুনের ব্যবস্থা করা। যে কর্মী বাহিনী চোঙা ফুঁকে নির্বাচনী মিছিল করবে তাদের চা-নাশতা আর সময় বিশেষে ভাত খাওয়ার বন্দোবস্ত করা। এর বাইরে অদৃশ্য কোনো খরচ যদি থেকেও থাকে, তবে তা এতই ব্যতিক্রম যে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থায় এর তেমন প্রভাব পড়ত না। এ পর্বে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার থেকে শুরু করে জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা সাধারণভাবে নিজেদের জনগণের নেতা বা সেবক ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন। নির্বাচনে যেটুকু ব্যয় হতো তা তাঁদের সাধারণ বাজেটের অন্তর্গত হিসেবেই মেনে নিতে অভ্যস্ত ছিলেন। নির্বাচনে জেতার পর বাজেটের ক্ষতিপূরণ নিয়ে তাঁদের কোনো ভাবনা থাকত না। আর্থিক সামর্থ্যহীন জনপ্রিয় নেতারা তখন মূল্য পেতেন। তাঁদের নির্বাচনী ব্যয় কিছুটা দল, কিছুটা সামর্থ্যবান এলাকাবাসীই বহন করত। এ কারণে বিরাট নির্বাচনী ব্যয়ের দায় মাথায় বইতে হতো না বলে সুদে-আসলে টাকা উসুলের দায়িত্বও বহন করতে হতো না। বেশির ভাগ নেতা নিজেদের জননেতাই মনে করতেন। জনকল্যাণকে তাঁরা ব্রত হিসেবে মানতেন।

কয়েক মাস পরেই বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তবে নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসলেও নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দলগুলোর মাঝে মতবিরোধ এখনো চরমে।প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করলেও তা মেনে নিতে নারাজ আওয়ামী লীগ সরকার। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না, এমন ধারণা থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে আসছে বিএনপি।

সামাজিক অবক্ষয়

ক্রমেই সামাজিক অবক্ষয় আমাদের অনেকটা বিধ্বস্ত করে ফেলছে যেন। দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত ঔজ্জ্বল্যকে নানা নৈরাজ্য অনেকটা বিবর্ণ করে ফেলছে। ঘুষ-দুর্নীতি এ দেশের ইতিহাসে পুরনো রোগ। তবে একসময় ঘুষখোররা লুকিয়ে ঘুষ খেত। বাবার অপকীর্তির জন্য সন্তানরা লজ্জিত থাকত। এখন অনেক সন্তানই বাবার অবৈধ সম্পদের জোয়ারে আনন্দে আর গর্বে ভাসে, স্ত্রীরা অনেক খুশি, অনেকের স্ত্রীরা নিজেকে নেত্রী হিসেবে ভাবেন।

ন্যায়বর্জিত চর্চার মাধ্যমে আমাদের সমাজব্যবস্থা মানবিকতায় না গিয়ে দানবিকতায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সমাজের পারিপার্শ্বিক অবস্হা শিশুর কোমল হূদয়কে দানবিক করে তোলে। দিনে দিনে আমাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে চলেছে। অনিয়ম, যথাযথ শিক্ষার অভাব, অপরাধের প্রশয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্বল নৈতিক অবস্থান, ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব, এগুলো সামজিক অবক্ষয়ের জন্য বিশেষভাবে দায়ী, এ অবক্ষয় রোধে কাজ করতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরে। আমাদের দেশে একটি শিশু জন্মলাভ করার পরে তার পিতামাতা তাকে শিক্ষিত করে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকেন, কিন্তু এর পেছনে বড় কারণ তাকে ভালো মানুষ করা বা মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে না তুলে বরং বড় বড় সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষা অর্জিত হয় তার, যাতে ভালো চাকরি করতে পারে ।

তাই তো আমাদের দেশে সাক্ষরতা হার বাড়লেও সুশিক্ষার হার বাড়ে না। দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে জীবনের সব স্তরে।পরিবার থেকেই শিশুর নৈতিক ও মানবিক অবস্হান দৃঢ় করার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে, পিতামাতার মধ্যকার সম্পর্ক, সম্মানের প্রতি তাদের আচরণ, ভালোবাসা, সময় দেওয়া এগুলো শিশুর বিকাশকে প্রভাবিত করে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও শুধু একাডেমিক পড়াশোনার ওপরে জোর দেওয়া হয়। অর্থাৎ শিক্ষার সবটুকুই কাগজে-কলমে। সামাজিক অবস্হার পরিবর্তন আনতে আমাদেরকে এখানেও পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষা অবশ্যই জীবনমুখী হতে হবে এবং জীবনে শিক্ষার প্রভাব ফুটিয়ে তুলতে হবে। আইনের চোখে সবাই সমান, এ ধারাটি আরো জোরালো ভাবে সবার মধ্যে গেঁথে দেওয়ার দৃষ্টান্ত স্হাপন করতে হবে। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করতে ব্যক্তিসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

সমাজের গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসা মানুষেরা যেন যুব সমাজের অনুপ্রেরণা হতে পারে, আদর্শ হতে পারে, এসব খেয়াল রেখে জনপ্রতিনিধি বাছাই করতে হবে। কর্মজীবন থেকে ব্যক্তিজীবনে সততা, নৈতিকতা, মানবিকতার, পরমতসহিষ্ণতার চর্চা করতে হবে। মানুষের মধ্যে এগুলোর চর্চা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে সরকার এবং এনজিওগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যে কোনো অবস্হান থেকে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানসিকতা দেখাতে হবে। তাহলেই আমারা পারব নৈতিকতা, মানবিকতার এবং ব্যক্তিসচেতনতার দৃঢ় অবস্হানের সঙ্গে একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে।

লেখকঃ সাংবাদিক, কলামিস্ট। সাধারণ সম্পাদক ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব ও সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার্স , দৈনিক বাংলাদেশের আলো।