নগরীর আলো আর সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে আধুনিক গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকাশিত: ৯:৫২ অপরাহ্ণ, জুন ৩, ২০২৫ তালুকদার আব্দুল্লাহ আল ফারুক রিংকুঃ কথায় আছে যুগে যুগে মীরজাফর তৈরী হয় কিন্তু নবাব তৈরী হতে শতাব্দী পেড়িয়ে যায়। আর তার বাস্তব উদাহরনের থাবা যেন আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি তার আতুর ঘর। বাংলাদেশ অর্থনীতির হার্ট বা লাইফ বলতে খ্যাত চট্টগ্রাম যার মাধ্যমে বাংলাদেশের চাকা সচল থাকে আর সেই সচল চাকা অচল করার জন্য আমাদের প্রতিবেশী মাফিয়া আর এদেশের নব্য এজেন্টরা রাজনীতির আড়ালে যাতে এ দেশের জনগনকে আজীবন গোলামীর শৃংখলে আবদ্ধ রাখতে পারে তার ই প্রানপন চেষ্টা করে যাচ্ছে। আসুন ব্যাপারটা একটু চিন্তা করে দেখা যাক, আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে সবচেয়ে বেশী মাথা ব্যাথার কারন হল লীড টাইম নিয়ে। আপনারা জানলে অবাক হবেন হয়তো, যতো না আমাদের কোয়ালিটির জন্য আমরা বায়ার হারাচ্ছি, তার চেয়ে আমরা বেশি মার খাচ্ছি ভিয়েতনামের কাছে। তাও শুধু এই লীড টাইমের জন্য। বেসিক্যালি এই লিড টাইম হল একটি অর্ডার প্লেস হবার পর সেই অর্ডার পন্য তার স্টোরে পৌছার টাইম। বাংলাদেশ কোটার মাধ্যমে বায়ার ধরে রেখেছে, কিন্তু ভিয়েতনামের এসব লাগছে না কারন ওদের লীড টাইম প্রায় ৭ থেকে ১৩ দিন কম লাগে আমাদের চেয়ে। অন্যদিকে আমাদের ফ্যাক্টরি বন্ধ হচ্ছে একের পর এক। আরো বেশি হবে কারন এই লীড টাইম এবং এই বন্দরের স্লোনেস এর জন্য। আমাদের কার্যত বন্দরের ইফিসিয়েন্সি বাড়াতে হবে কারন লীড টাইম সম্পূর্ণ বায়ার নির্ভর। তারই প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার ১১টি দেশের ১৫টি বন্দরের তুলনায় আমাদের বন্দর অনেক পিছিয়ে। এই পিছিয়ে পড়ার কারণে শুধু রপ্তানি খাতেই নয়। বিদেশি বিনিয়োগেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই বর্তমান সরকার গভীর সমুদ্র বন্দর এবং তার ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্ব আরোপ করেছে। আর বৈশ্বিক রাজনীতির আলোচনায় তাই এটি সবচেয়ে মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাড়িয়েছে। আমাদের সরকারের আহবানে জাপান কারিগরি এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যেটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক এবং যে দেশের কোন আগ্রাসী নীতি নেই। ১৯৭৬ সালের পর থেকেই জাপান বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সাহায্যকারী দেশ হিসাবে পরিচিত।। এখন দেখা যাক চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কি কিঃ জাহাজ ঘাট পাওয়ার জন্য গড়ে ২.১৫ দিন সময় লাগে ➔ বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একটি। টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম ৩.২৩ দিন ➔ বেশিরভাগ আধুনিক বন্দরে এটি দেড় দিনেরও কম। ক্রেনের গতি অত্যন্ত কম ➔ প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ১০-১২টি কনটেইনার ওঠানামা, যেখানে অন্য বন্দরে ২৫-৩০টি। একটি ঘাটে ঘণ্টায় ৩৫টি কনটেইনার হ্যান্ডেল হয় ➔ কলম্বোতে ৮০-১০০টি, গুজরাটে ২১৫টি, কেনিয়াতেও আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। ডিউয়েল টাইম (রপ্তানি পণ্যের জন্য জাহাজে ওঠানো থেকে বের হওয়া পর্যন্ত সময়) ১১ দিনের বেশি ➔ ভিয়েতনামে ৫-৭ দিন, কলম্বোতে ৭-৮ দিন। বিশ্বব্যাংক র্যাংকিং-এ চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৪০৫টির মধ্যে ৩৩৪তম ➔ এই অবস্থান আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। কেন এই অবস্থা? দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট: ➔ বন্দর ব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিতে জর্জরিত। অদক্ষ অপারেটর: ➔ দেশি অপারেটররা টেন্ডারে কম দাম দিলে কাজ পায় না, বরং বেশি দর দিয়ে কাজ পেয়ে বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। বিদেশি অপারেটর নিয়ে অহেতুক আতঙ্ক: ➔ উন্নত দেশগুলোর অপারেটররা বিশ্বের ৩০-৭০টি বন্দরে কাজ করলেও কোথাও মালিকানা নেয়নি। অথচ আমাদের দেশে বিদেশি অপারেটর আসলেই ‘বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছে’ বলে অপপ্রচার চালানো হয়। রাজনৈতিক দুঃরভিসন্ধির পরিচয়। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এক্সপার্ট হ্যান্ড এর সাথে আলোচনা করে এর ক্ষতির কারনগুলো তুলে ধরা আর যদি না হয় দেশের সার্থে কথার খাতিরে বিরোধিতা না করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। বিদেশি বিনিয়োগে প্রভাব: বিলম্বিত শিপমেন্টে বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ➔ সময়মতো পণ্য না পৌঁছালে অর্ডার বাতিল হচ্ছে। নতুন বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে এড়িয়ে যাচ্ছে ➔ দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য শিপমেন্ট না থাকলে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ ➔ ভিয়েতনাম, কলম্বো, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। সমাধান কী? উন্নত অপারেটর নিয়ে আসা: ➔ পোর্ট অকুপেন্সি ৮০% থেকে কমে ৬০%-এর নিচে নামবে। ➔ গেট থেকে জাহাজে মাল পৌঁছাতে ২২ দিনের বদলে ৯ দিন লাগবে। ➔ রপ্তানিকারকরা বাঁচবে, ব্যবসা বাড়বে। ➔ বাংলাদেশ বিনিয়োগকারীদের প্রথম পছন্দ হবে। ভুল ধারণার অবসান দরকার বিদেশি অপারেটর মানেই দেশ বিক্রি নয় ➔ সিঙ্গাপুর, কলম্বো, ভিয়েতনামে বহু বিদেশি অপারেটর কাজ করছে, তারা তো দেশ শেষ করে দেয়নি! দেশের স্বার্থে আধুনিকায়ন জরুরি ➔ আধুনিক বন্দরের জন্য দক্ষ অপারেটর, স্বচ্ছতা ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ দরকার। উদাহরন হিসাবে ভিয়েতনাম এ একটা জাহাজ যদি একদিনে ১ কোটি টাকার পন্য নিয়ে যদি বন্দর ছেড়ে যায় তাহলে ৩৬৫ দিনে হবে ৩৬৫ টাকা নূন্যতম ১% বন্দর প্রফিট করলে ৩.৬৫ কোটি টাকা আর সেই পন্য যদি বাংলাদেশ থেকে ৮ দিনে ১৭ টা সাইন নিয়ে ছেড়ে যায় তাহলে ৩৬৫ দিনে আয় হবে ৪৫.৬২৫ কোটি টাকা যার ১% প্রফিটে নীট লাভ হবে ৪৫ লাখ ৬২ হাজার ৫শত টাকা। তার অর্থ হল চোখের সামনে দিয়ে ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা নাই হয়ে গেলে। একবার ভেবে দেখুন? এটা যদি আপনার নিজের প্রতিষ্ঠান হত তাহলে আপনি কি করতেন?? তাইবদেশের উন্নয়ন ও বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস এবং চট্টগ্রামসহ সকল বন্দরকে আধুনিক ও দক্ষ করতে হবে। সিন্ডিকেট-দুর্নীতি রোধ করে, বিদেশি অপারেটরদের সুযোগ দিলে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে পারবে এবং নতুন বিনিয়োগ আসবে—এটাই সময়ের দাবি। এই সংকটের সমাধান আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাথা পিছু আয় নির্ধারণ এ ব্যাপক ভূমিকা নির্ধারণ করবে। যখন দিন পেরিয়ে রাত শেষ হবে তখন কোন এক ভোরে হয়ত আমাদের মত করে কোন এক ফরেন ডেলিগেটস স্টাটাস দিবে ‘’Skyline Meets Sealine : A Vibrant Night at the Modern Deep Sea Port ‘’ তাই অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়।। লেখক পরিচিতিঃ ম্যানেজার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড প্রোডাকশন প্লানিং ডিপার্টমেন্ট, আমানা গ্রুপ। সহ সভাপতিঃ বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং, প্লানিং এন্ড অপারেশন এসোসিয়েশন (নাঃগঞ্জ জোন)। SHARES অর্থনীতি বিষয়: