টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন ভারত

প্রকাশিত: ১২:৫৯ অপরাহ্ণ, জুন ৩০, ২০২৪

শনিবার রাতে বার্বাডোজে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৭ রানে হারিয়েছে ভারত। শুরুতে ব্যাট করে ৬ উইকেট হারিয়ে ১৭৬ রান করে ভারত। ওই রান তাড়া করতে নেমে ৮ উইকেট হারিয়ে ১৬৯ রানের বেশি করতে পারেনি প্রোটিয়ারা।

টস জিতে ব্যাট করতে নেমে প্রথম আট বলের পাঁচটিতেই বাউন্ডারি পায় ভারত। মার্কো ইয়ানসেনের করা প্রথম ওভারে তিনটি বাউন্ডারি হাঁকান বিরাট কোহলি, আসে ১৫ রান। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে সবচেয়ে খরুচে প্রথম ওভার করেন ইয়ানসেন।

পরের ওভারে স্পিনার কেশভ মাহারাজকে নিয়ে আসেন প্রোটিয়া অধিনায়ক এইডেন মার্করাম। তাকে প্রথম দুই বলে বাউন্ডারি হাঁকান রোহিত। এক বল ডট দেওয়ার পরেরটিতেই উইকেট এনে দেন মাহারাজ। তাকে সুইপ করতে গেলে বল কিছুটা শূন্যে ভেসে ছিল, স্কয়ার লেগে নিচু হওয়া ক্যাচ দারুণভাবে নেন হেনরিখ ক্লাসেন। ৫ বলে ৯ রান করে ফিরতে হয় রোহিতকে।

মুখোমুখি হওয়া দ্বিতীয় বলে আউট হয়ে যান ঋষভ পান্তও। সুইপ করতে গিয়ে ব্যাটের আগায় লেগে বল উপরে উঠে যায়, সহজ ক্যাচ নেন কুইন্টন ডি কক। ২ বলে শূন্য রান করে আউট হন পান্ত। ভালো শুরুর পর হুট করেই খেই হারায় ভারত।

তাদের বিপদ আরও বাড়ে পঞ্চম ওভারের তৃতীয় বলে সূর্যকুমার যাদব আউট হলে। কাগিসো রাবাদার বলে ফাইন লেগে তার ক্যাচ নেন ক্লাসেন। ৪ বলে ৩ রান করে ফেরত যান সূর্য। এরপর পাঁচে অক্ষর প্যাটেলকে পাঠায় ভারত। তাদের এই কৌশল কাজে লাগে ভালোভাবেই।

বিরাট কোহলিকে সঙ্গে নিয়ে ইনিংস টানেন অক্ষর। সুযোগ পেলেই ছক্কা হাঁকিয়ে রানের চাকাও সচল রাখেন। কোহলির সঙ্গে তার জুটি ছাড়িয়ে যায় পঞ্চাশ রান। কিন্তু নিজের হাফ সেঞ্চুরি ছুতে পারেননি তিনি। অক্ষরের অলসতা ও কুইন্টন ডি ককের চতুরতায় কোহলির সঙ্গে তার জুটি ভাঙে।

রাবাদার বলে ফ্লিক করতে যান কোহলি। কিন্তু ঠিকঠাক টাইমিং হয়নি, বল থাকে উইকেটরক্ষকের কাছাকাছি। এর মধ্যে রান নেওয়ার চেষ্টা করেন অক্ষর, কিন্তু কোহলি ফিরিয়ে দেন তাকে। ফেরার জন্য যথেষ্ট সময় পেলেও দ্রুততা ছিল না অক্ষরের। উইকেটরক্ষকের জায়গা থেকে সরাসরি থ্রোতে নন স্ট্রাইক প্রান্তে স্টাম্প ভাঙেন ডি কক। ৩১ বলে ১টি চার ও চারটি ছক্কায় ৪৭ রান করে সাজঘরে ফেরত যান অক্ষর।

তার বিদায়ের পর হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন কোহলি। এই টুর্নামেন্টে প্রথমবার এই মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। আগের সাত ইনিংসে স্রেফ ৭৫ রান করেছিলেন, দুবার আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে। ফাইনালে ৪৮ বলে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন কোহলি।

ফিফটি পাওয়ার পর কিছুটা চালিয়ে খেলার চেষ্টা করেন কোহলি। হাফ সেঞ্চুরি পাওয়ার পরের ১১ বলে ১৬ রান আসে তার ব্যাট থেকে। মার্কো ইয়ানসেনের আগের বলে ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন। পরেরটি একটু স্লো করেন তিনি, এবার পুল করতে গিয়ে ক্যাচ দেন রাবাদার হাতে।

কোহলির সঙ্গে পরে পঞ্চাশ পেরোনো জুটি হয়েছিল দুবেরও। ইনিংসের দুই বল বাকি থাকতে আউট হন দুবে। ১৬ বলে ৩টি চার ও ১টি ছক্কায় ২৭ রান করে সাজঘরে ফেরেন তিনি। শেষ বলে জাদেজাও আউট হন। তবে ততক্ষণে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান করে ফেলেছে ভারত। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করা অস্ট্রেলিয়ার ১৭৩ রান টপকে তারা করে ১৭৬ রান।

রান তাড়ায় নেমে শুরুতেই স্বস্তি উবে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার। ভারতের হয়ে কাজটি যার করার কথা ছিল, করেছেন তিনিই। দুর্দান্ত এক ডেলেভারিতে রেজা হেনরিকসকে বোল্ড করে সাজঘরে ফিরিয়ে দেন জাসপ্রিত বুমরাহ। ৫ বল খেলে ৪ রান করে আউট হন রেজা।

দ্বিতীয় উইকেটের জন্যও খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি ভারতকে। আর্শদ্বীপের করা পরের ওভারে মার্করাম ক্যাচ দেন উইকেটের পেছনে। দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়া দলকে টেনে তোলেন ডি কক, তার সঙ্গী হন ক্রিস্তিয়ান স্টাবস। পাওয়ার প্লের শুরুতে চাপে পড়া দলকে ছয় ওভারে ৪২ রান এনে দেন তারা।

যখন মনে হচ্ছিল স্টাবস-ডি কক জুটি জমে গেছে নবম ওভারে গিয়ে তখনই দুজনের জুটি ভাঙে। অক্ষরকে সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান স্টাবস। ২১ বলে ৩১ রান করে সাজঘরে ফেরত যান তিনি, ভাঙে ৩৮ বলে ৫৮ রানের জুটি। তার আউট হওয়ার পর হতাশায় নিজের ব্যাটে ঘুষি মারেন ডি কক।

কিন্তু তার পরের সঙ্গীকে নিয়েও দারুণভাবেই দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন তিনি। ভারতের ভয়ও বাড়তে থাকে। স্পিনের বিপক্ষে ভয়ঙ্কর ক্লাসেন নিজের সামর্থ্যের জানান দিতে শুরু করেন। কিন্তু এর আগেই সাজঘরে ফেরেন ডি কক। আর্শদ্বীপ সিংয়ের শর্ট বল তুলে মারতে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনের কাছে কুলদ্বীপ যাদবের হাতে ক্যাচ দেন ডি কক। ওই বলের আগেই তাকে নেওয়া হয়েছিল পেছনে।

এরপর উইকেটে এসে ক্লাসেনের সঙ্গী হন ডেভিড মিলার। আরও একবার দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসকে নতুন প্রাণ দেন তিনি। এমনকি ম্যাচটাও নিয়ে আসেন হাতের মুঠোয়। শুরুটা হয় কুলদ্বীপের করা ১৪তম ওভারে। শেষ দুই বলে চার ও ছক্কা হাঁকান মিলার।

পরের ওভারে আসা অক্ষরকে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে শুরু করেন ক্লাসেন। এরপর ওই ওভারে দুটি ছক্কা ও একটি চার হাঁকান তিনি। ওই ওভার থেকে আসে ২৪ রান। এই ওভারের আগে ৬ ওভারে দরকার ছিল ৫৪ রানের। অক্ষরের ওভারের পর সেটি হয়ে যায় ৩০ বলে ৩০ রান।

কিন্তু এই জায়গা থেকেও ম্যাচ আরও একবার মোড় নেয় উল্টোপথে। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানো ম্যাচে প্রাণ ফেরান হার্দিক পান্ডিয়া। তার করা ১৭তম ওভার শুরুর আগে কিছুটা সময় ব্যয় করে ভারত। মোমেন্টাম বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেন, সেটি তারা পারেনও। পান্ডিয়ার অফ স্টাম্পের বেশ বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন ক্লাসেন। ২৭ বলে ২ চার ও ৫টি ছক্কায় ৫২ রান করে সাজঘরে ফেরত যান তিনি।

ক্লাসেনের বিদায়ের পর অনুমিতভাবেই কঠিন হয়ে পড়ে ম্যাচ। ১৮তম ওভারে এসে দুই রান দিয়ে ইয়ানসেনের উইকেট তুলে নেন বুমরাহ। পরের ওভারে ৪ রান দেন আর্শদ্বীপ। শেষ ওভারে ১৬ রানের সমীকরণ আসে দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে।

তাদের জন্য তখনও সবচেয়ে বড় ভরসা মিলার। ৩০ বলে ৩০ থেকে ৬ বলে ১৬ রানের সমীকরণে চলে আসা ম্যাচেও তাদের একমাত্র আশা। কিন্তু প্রথম বলেই সেটি শেষ হয়ে যায়। হার্দিকের ফুলটস এগিয়ে এসে তুলে মেরেছিলেন মিলার। কিন্তু বাউন্ডারি লাইনে তখনই ওই অবিশ্বাস্য ক্যাচ নেন সূর্যকুমার।

এরপর বাকি পাঁচ বলে কেবল ৯ রানই করতে পেরেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। আরও একবার ‘এত কাছে তবুও কত দূরে’র গল্প লেখা হয়েছে তাদের সঙ্গে। ভারতের বহু বহু অপেক্ষার ইতি ঘটেছে এক জয়ে। হয়তো সরেছে শত কোটির চাপিয়ে দেওয়া ভীষণ এক চাপও, শিরোপা না জেতার; দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ভারতও বলতে পারে ‘আমরা যা জানি, তারা তো জানে না’!

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিলেন রোহিত

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিলেন রোহিত শর্মা। বিশ্বকাপ জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে এ কথা নিশ্চিত করেছেন তিনি। তবে টেস্ট ও ওয়ানডে ফরম্যাটে খেলা চালিয়ে যাবেন ভারতীয় অধিনায়ক।

পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে না বললেও সংবাদ সম্মেলনে ঠিকই বিদায়ের ঘোষণা দেন রোহিত। তিনি বলেন, ‘এটা আমারও শেষ ম্যাচ। খেলার শুরু থেকেই ফরম্যাটটি উপভোগ করেছি আমি। বিদায় জানানোর এটাই ভালো সময়। এই ফরম্যাটের প্রতিটি মুহূর্তকে ভালোবাসি আমি। সবসময় চেয়েছি ভারতের হয়ে ম্যাচ জিততে, ট্রফি জিততে। আমি বলতে পারি, এটাই আমার ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত। ‘

ফাইনালে কেবল ৯ রানে আউট হলেও বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে দারুণ ছন্দে ছিলেন রোহিত। ৮ ম্যাচে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৫৭ রান করেছেন। তবে অবসর নিচ্ছেন টি-টোয়েন্টির সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবে। ২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই ফরম্যাটে অভিষেক হয় তার। অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত ১৫৯ ম্যাচ খেলে ৩২.০৫ গড়ে ৪ হাজার ২৩১ রান করেছেন ডানহাতি এই ব্যাটার। ৪ হাজার ১৮৮ রান নিয়ে তার ঠিক পরেই আছেন কোহলি।

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ডটাও যৌথভাবে রোহিতের দখলে। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের সমান পাঁচটি সেঞ্চুরি আছে তার। পাশাপাশি ফিফটি করেছেন ৩২ ম্যাচে। এছাড়া সর্বোচ্চ ছক্কার (২০৫) রেকর্ডেও চূড়ায় আছেন তিনি।  এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সবগুলো আসর খেলেছেন কেবল দুজন ক্রিকেটার। তবে রোহিত থেমে গেলেও খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান।

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিলেন কোহলি

বিশ্বকাপ জিতেছেন। জিতেছেন ম্যাচসেরা পুরস্কারও। সেই পুরস্কার নিতে এসেই বিরাট কোহলি জানালেন, ভারতের হয়ে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে আর দেখা যাবে না তাকে। বিশ্বকাপ ফাইনালই ছিল এই ফরম্যাটে তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ।

কোহলি বলেন, ‘ভারতের হয়ে এটাই আমার শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ ছিল। আমরা ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে চেয়েছিলাম। হেরে গেলেও যে বলতাম না (অবসরের ব্যাপারে), তেমনটা নয়। এটা ওপেন সিক্রেট ছিল। ‘

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ফাইনালের আগে সময়টা ভালো যাচ্ছিল না। সাত ম্যাচ খেলে কেবল ৭৫ রান এসেছে তার ব্যাট থেকে। কিন্তু কেন তাকে বড় মঞ্চের খেলোয়াড় বলা হয়, শেষ ম্যাচে এসেও এর প্রমাণ দিলেন তিনি। অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও কোচ রাহুল দ্রাবিড় আগেই জানিয়েছিলেন কোহলির কাছ থেকে বড় কিছুর আশা করছেন তারা। কোহলিও তাদের হতাশ করেননি। ওপেন করতে নেমে ৫৯ বলে ৬ চার ও ২ ছক্কায় খেললেন ৭৬ রানের দারুণ এক ইনিংস।  সেটাই ভারতকে এনে দেয় জয়ের পুঁজি।

ম্যাচসেরা হয়ে কোহলি বলেন, ‘এটাই আমার শেষ বিশ্বকাপ ছিল। ইশ্বর অসাধারণ, হয় এখন নয়তো আর কখনো নয় – এমন এক পরিস্থিতিতে দলের হয়ে কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছি আমি। পরের প্রজন্মকে দায়িত্ব তুলে দেওয়ার এটাই সময়। আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, তারা এখান থেকে দলকে আরও সামনে এগিয়ে নেবে। ‘

২০১০ সালে টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয়েছিল কোহলির। ক্যারিয়ার শেষ করেন ১২৫ টি-টোয়েন্টিতে ৪ হাজার ১৮৮ রান করে। যেখানে একটি সেঞ্চুরি ও ৩৮টি ফিফটি রয়েছে তার।

আসর সেরা বুমরাহ, ম্যাচ সেরা কোহলি

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের নবম আসর শেষ হয়েছে। এই আসরের সেরা খেলোয়ার নির্বাচিত হয়েছেন ভারতের পেসার জাসপ্রীত বুমরাহ। আর ফাইনালের সেরা একই দলের ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি।